বিচিন্ত কথন ড. মোহাম্মদ আমীন-এর লেখা একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রবন্ধ নাম শুনলে মনে হয়, কঠিন কিছু।
কিন্তু এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি পড়লে বোঝা যায়, প্রবন্ধও সহজ ও সুখপাঠ্য হয় উপন্যাসের মতো।পুস্তক, চিন্তার লালিত্য পোষণ হতে উৎসরিত আদর্শিক স্পন্দনের লিখিত রূপ। যা পাঠকদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। প্রত্যেক মানুষের মনে স্বকীয় চিন্তা-চেতনার নিবাস থাকে। তবে তা প্রকাশিত না হলে আলোচনার বাইরে থেকে যায়। ফলে এরূপ অপ্রকাশিত চিন্তনের কার্যকারিতা নিষ্প্রভ থেকে যায়। ব্যক্তির মতো কিংবা ব্যক্তির আদর্শ ও অনুভাবনার মতো ব্যক্তিভেদে চিন্তার রূপাবয়বও ভিন্ন হয়। শুধু তাই নয প্রকাশ ভঙ্গিতেও দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য। লেখালেখি একটি জটিল শিল্পকর্ম। জটিল শিল্পকর্ম হিসেবে লেখার বৈচিত্র্য-নিপুণতা সবচেয়ে সর্বজনীন আবার সবচেয়ে বিতর্কমুখর। কারো সঙ্গে কারো চিন্তা ও মননের মিল ঘটে যাওয়া যেমন অস্বাভাকি কিছু নয় তেমনি অস্বাভাবিক নয় অমিল হওয়া। বরং অমিল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থেকে যায়। আলোচ্য গ্রন্থে এই অমিলকে মেনে নিয়ে নিজস্ব চিন্তনকে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে কাউকে আহত করার বা কারও চিন্তাকে অবহেলা করার কোনো ইচ্ছা মোটেও প্রদর্শিত হয়নি। যদি এমন কিছু থেকে থাকে তবে সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থী।
লেখক বলেছেন, এই গ্রন্থে প্রকাশিত বক্তব্যসমূহ আমার নিজস্ব চিন্তার পরিস্ফুটন মাত্র। এখানে যে চিন্তন লৈখিকরূপে প্রকাশিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারণার মনাঙ্গিক বিচার-বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধিমাত্র। এক জনের চিন্তার সঙ্গে সবাই একমত হবেন, এমনটি আশা করা যায় না। তবে বক্তব্যসমূহের ঐক্যানৈক্যের মাধ্যমে পাঠকের মনে যে অনুভূতিই সৃষ্টি হোক না কেন এবং পুস্তকে বিধৃত বক্তব্যের পক্ষে বা বিপক্ষে যেই সমালোচনা হোক না কেন, ওটাই হবে আমার লেখার সার্থকতা। ঐকমত্য প্রকাশ যেমন চিন্তার স্ফূরণ তেমনি ভিন্নমত পোষণ করাও চিন্তার স্ফূরণ। বরং ভিন্নমত পোষণে যে ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি করে, তা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও তর্কে-বিতর্কে আরও জোরালো এবং যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় সবার মত বা অমতের প্রতি তিনি বিমল শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
(১) ভালোবাসা, (২) উন্নয়ন ও দুর্নীতি, (৩) জাত অজাত, (৪) দাম্পত্য জীবন, (৫)ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, (৬) স্বজনপ্রীতি ও দেশপ্রেম, (৭) অহঙ্কার পতনের মূল কথাটি ভুল,(৮) সত্য জানার কৌশল, (৯) বিবেচক অতিথি, (১০)রূপ ও গুণ, (১১)শেখ সাদী ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কুকুর, (১২) স্বাধীনতা, (১৩)স্বপ্ন ও কল্পনা, (১৪)আস্থা বিশ্বাস ভালোবাসা, (১৫)সুখ শান্তি কষ্ট, (১৬)নিয়ন্ত্রণ, (১৭)ধর্ম বিশ্বাস জ্ঞান, (১৮)ধারণা ও বিশ্বাস, (১৯)মানুষ, (২০)ব্যক্তি ও নাম এবং (২১) বউ বস ও সঙ্গী- এই একুশটি প্রবন্ধ নিয়ে বইটির পরিধি সজ্জিত। আমি বইটির পাণ্ডুলিপি পড়ে বিস্মিত হয়েছি। কারণ লেখক প্রত্যেকটি বিষয়ে এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন, যা সম্পূর্ণরূপে তার নিজস্ব। এখানে তিনি কাউকে অনুসরণ করেননি। যদি কারো সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে তা কাকতালীয় এবং মৌলিকত্বের নিদর্শনই হবে।
মানুষ প্রবন্ধ শুরু হয়েছে এভাবে, মানুষ পোশাকাবৃত পশু। মানুষ ছাড়া অন্য কারও কাছে সে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং মানুষের অনুপস্থিতিটাই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যত বাড়ে বন্ধুত্ব তত কমে, যেখানে মানুষ কম সেখানে
|
ড. মোহাম্মদ আমীন |
বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব তত প্রগাঢ়। এ জন্য যত বড় শহর তত বেশি নির্জনতা। মানুষ যত বাড়ে পণ্যের মতো তার মূল্যও তত কমে। আবার মানুষ যত বাড়ে পণ্যের দামও তত বাড়ে। সুতরাং মানুষ শুধু পশু নয়, এক প্রকার পণ্য; পণ্যের মূল্য।” ধর্ম বিশ্বাস ও জ্ঞান প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদ পড়লে মন নতুন ধারণায় বিকশিত হয়ে উঠে। লেখক বলেছেন, “ধর্ম কী? বিশ্বাসে বাধ্য করার বিধিমালা। বিশ্বাস করতেই হবে, কোনও প্রশ্ন নয়; কোনো সন্দেহ নয়- এটিই ধর্ম। বিশ্বাস ধর্মের ভিত্তি। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ধর্মও নেই। বিশ্বাস মানে কী? বিশ্বাস ধারণার আদিপর্ব। অন্য কথায় জ্ঞানপূর্ব ধারণা। যেটি কখনও প্রমাণ করা যায় না আবার অপ্রমাণ করাও তত সহজ নয়। মূলত এটিই বিশ্বাস। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে বিশ্বাসের হেতু? ধর্মে এর বিকল্প নেই। বিশ্বাস না করলে ধর্মমতে অধার্মিক। বিশ্বাস ধর্মের শ্বাস। বিশ্বাস ধর্মকে ব্যক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। যার মধ্যে বিশ্বাস আছে সে-ই ধার্মিক। যার মধ্যে প্রাণ আছে সে জীব, যার মধ্যে বিশ্বাস আছে সে ধার্মিক। বিশ্বাস যেহেতু জ্ঞানপূর্ব ধারণা সেহেতু ধার্মিক হতে হলে জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
ভালোবাসা প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, ভালোবাসা উদ্দেশ্য পূরণের নান্দনিক কৌশল। ভালোবাসা নামের পুষ্পময়
|
চয়নিকা জাহান চৌধুরী |
প্রত্যয়টি স্বার্থের মমতায় লোমে লোমে এত বেশি নান্দনিক থাকে যে, যে কোনো স্বার্থকে নিঃস্বার্থ মাদকতায় ফেনিল করে দিতে পারে। এই নান্দনিকতাই ভালোবাসা নামক কুশলী বিনয়োগটাকে, সাধারণ বিনিময় থেকে আলাদা করে রাখে। এজন্য ভালোবাসা, পরাজয়কেও মহা-বিজয়ের চেয়ে বিমল আনন্দে ভরিয়ে দিতে পারে। ভালোবাসা যেখানে যত গভীর, সেখানে নত হওয়া তত গৌরবের। তবে আর্থিক দীনতা গভীর সম্পর্ক পর্যন্ত ভেঙে দেয়। আর্থিক লালিত্যে আত্মিক হৃদ্যতা কঠিন ও সর্বজনীন হয়ে ওঠে। চাওয়া-পাওয়া ভালোবাসার শ্বাসপ্রশ্বাস। প্রাপ্তিযোগ ফুরিয়ে গেলে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসাও ফুরিয়ে যায়। তাই জীবন্ত ভালোবাসায় কিছু চাওয়া পাওয়া জীবের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো অনিবার্য।” প্রতিটি প্রবন্ধ এমন সব মৌলিক চিন্তায় সজ্জিত। প্রবন্ধ সাধারণত কঠিন হয়ে থাকে, ভারী কথাগুলি আরো ভারী হয়ে সাধারণ পাঠককে প্রবন্ধবিমুখ করে তোলে। কিন্তু বিচন্ত কথন এমন একটি প্রবন্ধরাশি, যার প্রতিটি প্রবন্ধ গল্পের মতো সুখপাঠ্য। একটানে গল্পের মতো পুরো বই না পড়ে উঠা যায় না। আমিও তাই করেছি। নতুন চিন্তা জাগ্রত এবং মনোভাবকে বিকশিত করার জন্য বইটি যে কারো সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে।
পুস্তকটির প্রকাশক পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা। পাওয়া যাবে, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পুথিনিলয় এর স্টলে।